যুক্তরাজ্যে টিউলিপ সিদ্দিককে নিয়ে নানা খবরের মধ্যে এবার আলোচনায় এসেছেন সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান এফ রহমান। যুক্তরাজ্যের রাজা তৃতীয় চার্লসের হাত ধরে গড়ে ওঠা একটি দাতব্য সংস্থার একটি উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যান তিনি।
দারিদ্র্য বিমোচনে কাজ করার লক্ষ্যে ২০০৭ সালে ‘ব্রিটিশ এশিয়ান ট্রাস্ট’ নামের এই দাতব্য সংস্থা গড়ে তুলেছিলেন তৎকালীন ব্রিটিশ রাজপুত্র তৃতীয় চার্লস। যুক্তরাজ্যভিত্তিক সংবাদমাধ্যম দ্য সানডে টাইমস জানিয়েছে, ২০১৮ সালে এই সংস্থা বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। সে বছর লন্ডনের বাকিংহাম প্যালেসে এক নৈশভোজের অনুষ্ঠানে সবার সামনে সায়ান রহমানের প্রশংসা করেছিলেন চার্লস। বলেছিলেন, ‘আমি শুধু এটুকুই বলতে পারি যে সায়ান রহমান যে সহায়তা দিচ্ছেন, তার জন্য আমি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ।’
বাংলাদেশের বেক্সিমকো গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা সায়ান এফ রহমান ওই দাতব্য সংস্থায় ২ লাখ ৫০ হাজার পাউন্ড অনুদান দিয়েছিলেন বলে ধারণা করা হয়। এই সংস্থার উপদেষ্টা পরিষদে রয়েছেন ভারতের ধনকুবের মুকেশ আম্বানি। তিনিও একটি উপদেষ্টা পরিষদের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে রয়েছেন।
সূত্র বলেছে, চার্লসের দাতব্য সংস্থায় সায়ান এফ রহমানের দেওয়া অর্থ ভালো মনে করে নেওয়া হয়েছিল এবং সেগুলো এশিয়ার বিভিন্ন প্রকল্পে খরচ করা হয়েছে। আর ব্রিটিশ এশিয়ান ট্রাস্টের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘সায়ান এফ রহমানের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠেছে, সে সম্পর্কে আমরা অবগত আছি এবং বাংলাদেশে এ বিষয়ে কী অগ্রগতি হচ্ছে, তার ওপর আমরা নজর রাখছি।’
ছাত্র–জনতার অভ্যুত্থানে ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের কিছুদিনের মধ্যে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সালমান এফ রহমান। ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে সায়ান রহমান (৪২) কোথায় আছেন, তা স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশে সালমানের পাশাপাশি সায়ান এফ রহমান ও তাঁর স্ত্রীর ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়েছে। এ বিষয়ে তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তাঁদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ থেকে আট কোটি ডলারের বেশি অর্থ বিদেশে পাচারের অভিযোগ আনা হয়েছে।
লন্ডনে সায়ান এফ রহমানের এসব কর্মকাণ্ড বেরিয়ে এসেছে দেশটির অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থনীতিবিষয়ক মিনিস্টার টিউলিপ সিদ্দিকের ব্যবহৃত সম্পত্তির অনুসন্ধান করতে গিয়ে। সানডে টাইমসের অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সায়ান এফ রহমান একটি অফশোর ট্রাস্টের মাধ্যমে উত্তর লন্ডনের গোল্ডার্স গ্রিন এলাকায় ১২ লাখ পাউন্ড দিয়ে একটি বাড়ি কিনেছিলেন। ওই বাড়িতে থাকতেন টিউলিপের মা ও শেখ হাসিনার বোন শেখ রেহানা। এ ছাড়া লন্ডনের গ্রসভেনর স্কয়ারে সায়ান রহমানের ৪ কোটি ২০ লাখ পাউন্ড দামের একাধিক সম্পদ রয়েছে।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক ডেইলি মেইলের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, শেখ রেহানা লন্ডনে ১৩ লাখ ডলার মূল্যের সায়ানের বাড়িতে বিনা ভাড়ায় থাকতেন।
সায়ান এফ রহমানের একজন মুখপাত্র ডেইলি মেইলকে বলেছেন, ‘সায়ান রহমানের জন্ম ব্রিটেনে। তিনি ব্রিটিশ নাগরিক এবং একজন সফল আন্তর্জাতিক ব্যবসায়ী। তাঁর বা তাঁর স্ত্রী কারও বিরুদ্ধে কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের অভিযোগ আনা হয়নি। শুধু তাঁদের বাংলাদেশি ব্যাংক অ্যাকাউন্টগুলো জব্দ করা হয়েছে, তা–ও করা হয়েছে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার জন্য আরও তিন শর বেশি ব্যক্তির সঙ্গে। এটা পুরোপুরি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
গত বৃহস্পতিবার ঢাকার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় সানডে টাইমসকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ থেকে পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনার কথা বলেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। সেখানে সায়ান এফ রহমানের প্রসঙ্গে কৌতুক করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘উদার মানুষ, দেখুন? কেমন উদার…আমরা এখন সায়ানের নাম বলছি। কিন্তু অনেক সায়ান আছে যারা ককটেল পার্টিতে যাচ্ছে। এই মুহূর্তে তাদের নাম আসছে না।’
যুক্তরাজ্য থেকে নির্দিষ্ট কিছু সম্পদ উদ্ধারে বাংলাদেশকে সহায়তার আগ্রহ দেখিয়েছে ব্রিটিশ তদন্ত সংস্থা ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সিও (এনসিএ)। বাংলাদেশি গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গত অক্টোবরে ঢাকা সফর করেছেন এনসিএর কর্মকর্তারা।
বিদেশে থাকা সম্পদ উদ্ধারে যুক্তরাজ্যসহ সংশ্লিষ্ট সব দেশের আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সহযোগিতা করবে বলে প্রত্যাশার কথা জানিয়েছেন অধ্যাপক ইউনূস। টিউলিপ সিদ্দিকের পরিবারের সদস্যদের মালিকানায় থাকা বা তাঁদের ব্যবহার করা সম্পদগুলোর কী হবে—সে প্রশ্নের জবাবে তিনি সানডে টাইমসকে বলেন, ‘আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি যে তাঁদের বিচারের আওতায় আনব। আমাদের তথ্য–প্রমাণ দরকার। এই তথ্য–প্রমাণগুলো জোরদার হতে হবে, যা সাধারণত দরকার হয়।’
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘দেখুন, যেকোনো আইনজীবীর জন্য এটা বলা সহজ যে এটা (অভিযোগ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। তাই আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হবে যেন সেগুলো (অভিযোগ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হিসেবে খারিজ করে না দেওয়া হয়। এগুলো কঠিন সত্যি। আপনি যখন যুক্তরাজ্যে একটি ফ্ল্যাটের (অভিযোগ প্রমাণ) বিষয়টি আনবেন, তখন তা একটি বড় উদাহরণ হবে। কারণ, কেউ আর বলবে না এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত।’
খুলনা গেজেট/এইচ